চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী ভোটযুদ্ধ। এ প্রথমবারের মতো দলীয় ব্যানারে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে চট্টগ্রামে ১০টি পৌরবাসীর মধ্যে একদিকে ভোট উৎসব অপেক্ষা করলেও বিরাজ করছে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক। নির্বাচনের আগ মুর্হূতে সীতাকুণ্ড, সাতকানিয়াসহ কয়েকটি পৌরসভায় হামলা ভাঙচুর সংর্ঘষের ঘটনায় নির্বাচন আদৌ কতটুকু সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আলোচনা সমালোচনা চলছে।
চট্টগ্রামে ১০ পৌরসভার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন সোমবার মধ্যরাত থেকে বন্ধ হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। এরই মধ্যে ১০ পৌরসভায় ভোটগ্রহণের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছে গেছে ভোটগ্রহণের সরঞ্জাম।
মঙ্গলবার বিকাল থেকে পুলিশ প্রহরায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে যাচ্ছে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম। পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে ১০ পৌরসভা এলাকায় যানবাহনসহ সব ধরনের গাড়ি চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে জেলা প্রশাসন।
চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মেজবাহ উদ্দিনের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, মীরসরাই, বারইয়ারহাট, সীতাকুণ্ড, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও বাঁশখালী পৌরসভা এলাকায় ২৯ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত অটোরিকশা, ইজি বাইক, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো প্রভৃতি যানবাহন ও গাড়ি চলাচলে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা ২৭ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
এদিকে বিজিবি-পুলিশ ও র্যাবের সমন্বয়ে নিরাপত্তার প্রস্তুতিও শেষ হয়েছে। পৌর নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চট্টগ্রামের ১০ পৌরসভা এলাকায় মাঠে নেমেছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবিও কোস্টগার্ড সদস্যরা।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম জানান, সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্র হতে পেয়েছি, সে অনুসারে সকাল থেকে চট্টগ্রামের ১০ পৌরসভায় বিজিবি ও কোস্টগার্ড মোতায়েন হয়েছেন।
চট্টগ্রামে ১০ পৌরসভার সব প্রস্তুতি সম্পন্নজেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১০ পৌরসভায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন চার হাজারের মতো আনসার পুলিশ। দুই হাজার ১০০ অস্ত্রধারী পুলিশ এবং এক হাজার ৯০০ আনসারের পাশাপাশি ১৩ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি পৌরসভায় এক প্লাটুন করে এবং তিন পৌরসভায় দুই প্লাটুন করে বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তিনটি কেন্দ্র মিলে থাকবে একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ টহল টিম। পাঁচটি কেন্দ্র মিলে থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স। থানায় স্ট্যান্ডবাই ফোর্সও রাখা হবে। থাকবে মোবাইল কোর্ট। মোবাইল কোর্ট যে কাউকে জরিমানা করতে পারবে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপারেশন অফিসার লে. কমান্ডার নাসিরুদ্দিন একরাম বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪টি পৌরসভায় প্রায় ১৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি প্লাটুন গতকাল রাতেই নিজ নিজ এলাকায় পৌছেছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে টহল দিচ্ছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল বাতেন জানান, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ভোটগ্রহণের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। পুলিশ প্রহরায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এদিকে সরকার দলীয় লোকজনের হামলা, হুমকি-ধামকি ও পুলিশি হয়রানির মধ্যেই চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটুকু সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে শঙ্কিত বিএনপির নেতাকর্মী এবং প্রার্থীরা।
শেষে প্রচারণার সোমবার সাতকানিয়ায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর গাড়িবহরে সরকার দলীয় লোকজনের হামলা এ আতঙ্ক আরো বাড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে বিএনপি’র চট্টগ্রাম বিভাগীয় নির্বাচনী মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক, সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন উৎকন্ঠা প্রকাশ করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যে তারা সকাল ৯টার মধ্যে কেন্দ্র দখল করে নেবে এবং অস্ত্রহাতে এলাকায় এলাকায় ক্যাডাররা টহল দিচ্ছে। এ কারণে প্রত্যেক কেন্দ্রে আমাদের যারা এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা এবং আমাদের ভোটাররা শঙ্কিত। তবে আমাদের মনোবল শক্ত আছে আমরা শেষ পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে রেজাল্ট নিয়ে ফিরবো। আমরা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাবো তারা যেন নিরপেক্ষ থাকে। সরকারি কর্মকর্তাদের মনে রাখা দরকার এ সরকার শেষ সরকার না আরো সরকার আসবে। তাই তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার অনুরোধ করছি।
পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক বাহিনী মোতায়েন করা হলেও সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক কাটছেনা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ১০টি পৌরসভায় মোট ১৩৩টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১১৯টিই ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এদিকে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রয়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া আচরণবিধি বিএনপিকে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। সরকারি দলের প্রতিকূলে রয়েছে এই আচরণবিধি। এই আচরণবিধিতে সরকারি দলের চেয়ে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে বিএনপিই।
তিনি বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর বিএনপি জোট হামলা চালাচ্ছে অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচনে ভরাডুবি হবে এটা বুঝতে পেরে তারা উসকানি দিচ্ছে। আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এত উসকানি সত্ত্বেও আমরা আমাদের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরতে বলেছি।
নির্বাচনকে সামনে রেখে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘ভারতের চেয়ে আমাদের নির্বাচনী পরিবেশ অনেক ভালো। আর যেসব ঘটনা ঘটছে তাও বিএনপি জোটের উসকানির কারণেই হচ্ছে।
চট্টগ্রামে ১০ পৌরসভার সব প্রস্তুতি সম্পন্নচট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) কাজী আবদুুল আউয়াল জানান, পৌর নির্বাচনকে ঘিরে করে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি, র্যাব এবং আনসার পৌরসভাগুলোতে টহল শুরু করেছে বুধবার থেকে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের ১০ পৌরসভায় মোট ৪৪৯জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে মেয়র পদে ৩৪ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৩৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৭৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মেয়র পদে সীতাকুণ্ডে ছয়জন, মিরসরাইয়ে চারজন, বারইয়ারহাটে ৩ জন, সন্দ্বীপে ২ জন, রাউজানে ৩ জন, রাঙ্গুনিয়ায় ৪ জন, পটিয়ায় ৪ জন, চন্দনাইশে ৪ জন, সাতকানিয়ায় ৩ জন ও বাঁশখালীতে ২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
১০ পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ সাত হাজার ২১৫ জন। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ২০৯টি, ভোট কক্ষের সংখ্যা এক হাজার ২৩৪টি, অস্থায়ী ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ২টি, অস্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৫০টি।
১০ পৌরসভায় ৪০ জন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন। যে ১০টি পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে সেই পৌর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে মাঠে নেমেছিলেন ১০ ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের সঙ্গে গত রোববার থেকে মাঠে নেমেছেন আরও ৩২ ম্যাজিস্ট্রেট। সবমিলিয়ে ১০ পৌরসভায় দায়িত্ব পালন করছেন ৪২ জন ম্যাজিস্ট্রেট।